আল্লাহর ভয়

ভয়

৩- ভয়:

{আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন।} [সূরা আলে-ইমরান, আয়াত :৩০]।

ব্যাখ্যা:

আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করা কলবী ইবাদাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। আল্লাহ তা'আলা বলেন: {এরা যে রয়েছে, এরাই হল শয়তান, এরা নিজেদের বন্ধুদের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করে। সুতরাং তোমরা তাদের ভয় করো না। আর তোমরা যদি ঈমানদার হয়ে থাক, তবে আমাকে ভয় কর।}
[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ১৭৫]

উক্ত আয়াতের আলোকে বুঝা যায়, এক আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ করা মুমিনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। আয়াতটি থেকে জোরালোভাবে এও প্রমাণিত হয় যে, ভয় ঈমানের বৈশিষ্ট্যসমূহের মাঝে অন্যতম। সুতরাং বান্দার ঈমানের গভীরতার অনুপাতে তার মধ্যে আল্লাহর ভয় থাকবে।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: «আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম-{এবং যারা যা দান করবার তা কম্পিত হৃদয়ে দান করে’-} এরা কি ঐ সকল লোক যারা মদ পান করে এবং চুরি করে? তিনি বললেন: না হে সিদ্দীক কন্যা! এরা হচ্ছে ঐ সকল লোক যারা রোযা রাখে, নামায আদায় করে, সাদকা করে এবং তাদের এ কর্ম কবুল করা হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে।» (-তিরমিযী।)

আল্লাহভীতি সৃষ্টির উপায় সমূহ:

১- আল্লাহ তা'আলার প্রতাপ, মহত্ব এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন। {তারা তাদের উপর পরাক্রমশালী, তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে।}[সূরা: আন-নাহল, আয়াত: ৫০।]

২- যেস্থানে আমরা কেউই যেতে চাই না, সেই জাহান্নাম ও কঠোর শাস্তি এবং নিকৃষ্ট গন্তব্যে গমনের ভয় অন্তরে পোষন করা।

৩- আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত কর্তব্যপালনে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতির অনূভুতি অন্তরে লালন করা। সেই সাথে একথাও কল্পনায় রাখা যে, আল্লাহ তা'আলা সবকিছুই দেখছেন এবং সবাই তাঁর হাতের নাগালে। আর গুনাহের ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার কথা আমলে না এনে বরং সব সময় যার নাফরমানী করা হচ্ছে, সেই আল্লাহর মহত্বের কথা মাথায় রাখা উচিত।

৪- আল্লাহর কালাম-কুরআনে কারীমের সেইসব আয়াত সমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করা, যাতে রয়েছে আল্লাহর অবাধ্য ও শরীয়ত অমান্যকারী, এবং আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নূরকে পরিত্যগকারীর জন্য সতর্কবাণী ও হুশিয়ারী।

৫- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হাদীসের প্রতি গভীরভাবে চিন্তা করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত অধ্যয়ন করা।

৬- আল্লাহর বড়ত্বের কথা চিন্তা করা। কেননা যে আল্লাহর বড়ত্ব নিয়ে চিন্তা করবে, তার দৃষ্টিজুড়ে আল্লাহর গুনাবলী ও মহত্বের বিষয়গুলো বিরাজ করবে। আর যার অন্তর আল্লাহর মর্যাদা ও আযমত প্রত্যক্ষ করবে, সে আল্লাহকে অবশ্যই ভয় করবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন।}
[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ২৮।]

মহান আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে।} [সূরা: যুমার, আয়াত: ৬৭।]

আল্লাহর প্রতি ভয় আল্লাহ সম্পর্কে আরো জানতে বাধ্য করে, আর আল্লাহ সম্পর্কে জানলে তাঁর প্রতি অন্তর বিনয়ে অবনত হয়, যা মানুষকে আল্লাহর অনুগত করে।

৭- মৃত্যু ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা এবং এ বিষয়েও চিন্তা করা যে মৃত্যু থেকে পলায়নের কোন পথ নেই: আল্লাহ তা'আলা বলেন:{বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে।}
[সূরা: আল-জুমুয়া, আয়াত: ৮]

এটা আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- «দুনিয়ার স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে তোমরা অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। কেউ যদি মৃত্যুকে অসচ্ছল অবস্থায় স্মরণ করে তবে সে প্রশান্তি লাভ করবে, আর যে সচ্ছল অবস্থায় মৃত্যুকে স্মরণ করবে দুনিয়ার প্রতি তার আকর্ষণ কমে যাবে।» (তবরানী)

৮- মৃত্যু পরবর্তী জীবন, কবর এবং কবরের ভয়াবহতা নিয়ে চিন্তা করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- «আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করতাম, কিন্তু এখন তোমরা কবর জিয়ারত করো, কারণ এটা দুনিয়ার মোহ কমিয়ে দেয় এবং আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়।» (ইবনে মাজাহ।)

হযরত বারা রা. বলেন: «'আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একটি জানাজায় শরীক ছিলাম, এক পর্যায়ে তিনি কবরের পাশে বসে পড়লেন এবং এতো বেশি ক্রন্দন করলেন যে মাটি ভিজে গেল, এরপর বললেন- হে আমার ভাইয়েরা! এভাবে তোমরাও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো।»
(-ইবনে মাজাহ।)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-{হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব, পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক শয়তানও যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে।} [সূরা: লুকমান, আয়াত: ৩৩]

৯। ছোট ছোট গুনাহের ধ্বংসাত্মক পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করা; এসব গুনাহ মানুষকে তুচ্ছ ও লাঞ্চিত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদাহরণ পেশ করলেন একদল মুসাফিরের সঙ্গে, যারা 'বাতনে ওয়াদী' নামক জায়গায় অবতরণ করেছিলো, এরপর তারা সবাই মিলে রান্নার জন্য জালানী কাঠ সংগ্রহ করলো, এখানে কাঠ ও আগুন প্রজ্জলের মাঝে একটা প্রচেষ্টা ও সম্পর্ক রয়েছে। ঠিক একই ভাবে গুনাহগারের জাহান্নামে জ্বলার মাঝে তার কৃত গুনাহ সমূহের ভূমিকা ও সম্পর্ক রয়েছে: {তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে।}[সূরা: আল-নিসা, আয়াত: ৫৬]

১০। বান্দার জানা উচিত যে, হঠাৎমৃত্যু তার ও তওবার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাড়াতে পারে। সে ক্ষেত্রে অনুশোচনা ও আক্ষেপ কোন কাজে আসবে না। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {যখন তাদের কারও কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলে: হে আমার পালণকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে) প্রেরণ করুন।}[সূরা: আল-মুমিনুন, আয়াত: ৯৯।]

তিনি ইরশাদ করেন- {আপনি তাদেরকে পরিতাপের দিবস সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিন।}[সূরা: মারইয়াম, আয়াত: ৩৯।]

১১- অশুভ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করা। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{ফেরেশতারা কাফেরদের জান কবজ করে; প্রহার করে, তাদের মুখে এবং তাদের পশ্চাদদেশে।}
[সূরা: আল-আনফাল, আয়াত: ৫০।]

১২- এমন লোকদের সান্নিধ্যে বসা যাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় বিরাজমান। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে।}
[সূরা: আল-কাহাফ, আয়াত: ২৮।]

আল্লাহর ভয়ের দুটি দিক আছে:

(ক) আল্লাহর আজাবকে ভয়:

যে শাস্তির হুশিয়ারী প্রদান করা হয়েছে মুশরিক ও অবাধ্যদের জন্য এবং তাদের জন্য যারা তাকওয়ার পথ এবং আল্লাহর আনুগত্যকে এড়িয়ে চলে।

(খ) আল্লাহকে ভয় করা:

এই ভয়টি সাধারণত: উলামা ও আল্লাহর পরিচয়লাভকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে থাকে: {আল্লাহ তা'আলা তাঁর সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করেছেন।}[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ২৮।]

আল্লাহর মারেফাত ও পরিচয় যত বেশি থাকে, তার ভয়ও তত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন: {আমার বান্দাদের মধ্যে উলামারাই আল্লাহকে অধিক ভয় করে।}[সূরা: ফাতির, আয়াত: ২৮।]

কেননা উলামায়ে কেরাম যখন আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর মারেফাত তাঁর পূর্ণ পরিচয় লাভ করেন, তখন তাদের মাঝে আল্লাহভীতি বৃদ্ধি পায়। এরপর অন্তরে এর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে, অতঃপর পুরো শরীরে।

কারো অন্তরে যখন আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়, তখন তা প্রবৃত্তির মন্দ তাড়না ও চাহিদাগুলোকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয় এবং এর ফলে তার মন থেকে দুনিয়ার মোহ কমে যায়।

আল্লাহভীতির উপকারিতা ও ফলাফল:

(ক) আল্লাহভীতির পার্থিব ফলাফল:

১- আল্লাহর ভয় দুনিয়াতে মানুষকে কতৃত্ব এনে দেয় এবং ঈমান ও আন্তরিক প্রশান্তি বৃদ্ধি করে; কেননা, আপনি যখন প্রতিশ্রুত বস্তু লাভ করবেন, তখন প্রতিশ্রুতিদাতার প্রতি আপনার ভরসা আরো বেড়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {কাফেররা পয়গম্বরগণকে বলেছিল: আমরা তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেব, অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে। তখন তাদের কাছে তাদের পালনকর্তা ওহী প্রেরণ করলেন যে, আমি জালিমদেরকে অবশ্যই ধ্বংস করে দেব। তাদের পর তোমাদেরকে দেশে আবাদ করব। এটা ঐ ব্যক্তি পায়, যে আমার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে এবং আমার আযাবের ওয়াদাকে ভয় করে।}[সূরা: ইবরাহীম, আয়াত: ১৩- ১৪]

২- আল্লাহভীতি মানুষকে নেক আমল ও ইখলাসের প্রতি উৎসাহিত করে। সাথে সাথে দুনিয়াতে এর বিনিময় যেন কামনা না করে; বরং একনিষ্ঠতা অবলম্বন করে, সে মর্মেও উৎসাহিত করে। আখিরাতে এমন ব্যক্তির সাওয়াবে কোন হ্রাস হবে না। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {তারা বলে: কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। আমরা আমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে এক ভীতিপ্রদ ভয়ংকর দিনের ভয় রাখি।}
[সূরা: আল-ইনসান, আয়াত: ৯- ১০।]

কারো অন্তরে যখন আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়, তখন তা প্রবৃত্তির মন্দ তাড়না ও চাহিদাগুলোকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয় এবং এর ফলে তার মন থেকে দুনিয়ার মোহ কমে যায়।

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন: {আল্লাহ যেসব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে; এমন লোকেরা, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামায কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।}[সূরা: আন-নূর, আয়াত: ৩৬]

অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে তারা ব্যাকুল থাকে। আর এই চেতনাই তাদেরকে আমলের দিকে অগ্রসর করে। তারা নাজাত ও মুক্তির কামনা করতে থাকে এবং ধ্বংসের পথ পরিহার করে। তারা বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্তিকে ভয় করে।

যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে তবে সেই ভয় তাকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে।

(খ)আল্লাহভীতির পরকালীন ফলাফল:

১- আল্লাহর ভয়ে ভীত বান্দা কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- «এবং এমন ব্যক্তি (আরশের নিচে ছায়া পাবে) যাকে অভিজাত সুন্দরী কোন রমণী প্রস্তাব দেয়া সত্ত্বেও সে বলে; আমি আল্লাহকে ভয় করি।» (-বোখারী।)

বাহ্যত: উক্ত হাদীসে সুন্দরী রমনীর কুপ্রস্তাবের জবাবে, নেককার যুবক আল্লাহর ভয়ের কথাটি প্রকাশ করেছে, মহিলাকে নিবৃত করা ও নিজকে উপদেশ দানের জন্য। অর্থাৎ যেন সে ঘোষিত আল্লাহভীতির দাবি অনুসারে চলতে পারে। «এমন ব্যক্তি যে নিভৃতে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চোখের পানি ছেড়ে দেয়।» (-বোখারী,)

চোখে অশ্রুর প্রবাহ সৃষ্টিকারী ভয় মানুষকে এমন স্তরে নিয়ে যায় যে, কিয়ামতের দিন আগুন এই চোখ স্পর্শ করবে না।

২- ভয় মাগফিরাতের কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস এই সাক্ষ্যই দেয়-«পূর্বের যুগের এক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা'আলা অনেক ধন-সম্পদ দান করেছিলেন, মৃত্যুর সময় তিনি ছেলেদের ডেকে বললেন- আমি বাবা হিসাবে কেমন ছিলাম? তারা বলল- উত্তম, অতঃপর তিনি বললেন, আমি কোন নেক কাজ করি নাই, সুতরাং আমি যখন মারা যাবো তোমরা আমাকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিবে, এরপর তা পিষে গুড়ো করবে, তারপর তা ঝড়োবাতাসে উড়িয়ে দিবে। ছেলেরা নির্দেশ মত সব করল। অতঃপর আল্লাহ তার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একত্রিত করে বললেন- তুমি এমনটি কেন করেছিলে? সে বলল, আপনার ভয়। অতঃপর আল্লাহ তাকে রহমত ও দয়া দ্বারা বেষ্টন করে নিলেন।» (-বোখারী।)

যে ব্যক্তি আল্লাহর পুনর্জীবন দানের ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করে সে কাফের। কিন্তু উক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার অজ্ঞতাকে ওজর হিসাবে কবুল করেছেন আল্লাহ তা'আলা। তার ভয় রবের কাছে সুপারিশকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

৩- আল্লাহর ভয় মানুষকে জান্নাতে পৌঁছে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

«যে ভয় পায় সে আত্মরক্ষার্থে রাতে সফর করে, আর যে রাতে সফর করে সে সচেতনার কারণে গন্তব্যে পৌছতে পারে। তোমরা জেনে রেখো- নিশ্চয় আল্লাহর পুরস্কার অত্যন্ত দামী। আর তা হলো জান্নাত। (সুতরাং আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগরুক রাখো এবং সাবধানে দুনিয়ার জীবন পাড়ি দাও। তবেই গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবে।)» (-তিরমিযী।)

৪- যার মাঝে আল্লাহর ভয় আছে, সে কিয়ামতের দিন নিরাপদে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ করেন: «আমার ইজ্জতের কসম! আমার বান্দার জন্য দুটি ভয় ও দুটি নিরাপত্তাকে একত্রিত করি না। যদি সে দুনিয়ায় আমাকে ভয় করে তবে কিয়ামতে আমি তাকে নিরাপত্তা দান করব। আর দুনিয়ায় আমাকে যে নিরাপদ মনে করবে (ভয় না করবে) কিয়ামতের দিন তাকে আমি সন্ত্রস্ত রাখবো» (-বায়হাকী।)

৫- আল্লাহ তা'আলা তাঁর ঈমানদার বান্দাদের যেসব গুন-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন, আল্লাহভীতি অর্জনকারি ব্যক্তি সেসব গুন-বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে। যেমনটি আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-{ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ, ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী।}[সূরা: আল-আহযাব, আয়াত: ৩৫]

উক্ত আয়াতে মুমিনের গুন-বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বর্ণিত প্রত্যেকটি শব্দই মর্যাদাপূর্ণ, যা অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা করা উচিত।

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে, ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। কেউ জানে না তার জন্যে কৃতকর্মের কি কি নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুক্কায়িত আছে।}
[সূরা: আস-সিজদা, আয়াত: ১৬]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{যে ব্যক্তি দিনে ও রাতে সাজদা ও দণ্ডায়মান হয়ে আল্লাহর ইবাদাত করে এবং আখেরাতকে ভয় করে ও তার পালনকর্তার রহমত প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান, যে এরূপ করে না; বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।}
[সূরা: আয-যুমার, আয়াত: ৯]

আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- {এবং যারা তাদের পালনকর্তার শাস্তির সম্পর্কে ভীত-কম্পিত। নিশ্চয় তাদের পালনকর্তার শাস্তি থেকে নিঃশঙ্ক থাকা যায় না।}[সূরা: আল-মায়ারিজ, আয়াত: ২৭- ২৮]

আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি ভয় পোষণ করার কারণে তাঁর নৈকট্যশীল বান্দাদের প্রশংসা করেছেন। আর আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হচ্ছেন আম্বিয়ায়ে কেরাম: {তারা সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারা আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত।}
[সূরা: আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৯০]

ফেরেশতাগণও আল্লাহ তা'আলাকে ভয় করে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-{তারা তাদের উপর পরাক্রমশালী, তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং তারা যা আদেশ পায়, তা করে।}
[সূরা: আন-নাহল, আয়াত: ৫০]

৬- আল্লাহর সন্তুষ্টি:{আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটা তার জন্যে, যে তারা পালনকর্তাকে ভয় করে।}
[সূরা: আল-বাইয়্যেনাহ, আয়াত: ৮।]

যাঁরা আল্লাহকে প্রকৃতই চিনতে পেরেছেন, সেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভয়:

আল্লাহর পরিচয় লাভকারী বান্দারা সর্বদা নেক আমলে মগ্ন থাকেন। তারা কখনো নিরাশ হন না। তারাই আল্লাহর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী ভয় ও বিনয় পোষণ করেন। এর একটি উদাহরণ হলো:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এত অধিক ক্রন্দন করতেন যে, ক্রন্দনের ফলে তাঁর বুক দিয়ে ফুটন্ত ডেকের শব্দের মত (গম্ভীর) শব্দ শোনা যেত। (আহমদ, আবু-দাউদ ও নাসাঈ।)

আবু বকর রা. জিহ্বা ধরে বলতেন:

«এটাই আমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে এসেছে।»

এবং তিনি বলতেন:

'«হায়! আমি যদি এমন কোন উদ্ভিদ হতাম যা কেউ ভক্ষণ করে ফেলত!»

উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলতেন:

«আহ! আমি যদি সৃষ্টিই না হতাম!! হায়! আমার মা যদি আমাকে প্রসব না করতেন!!»

এবং তিনি আরো বলতেন:

«ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি ক্ষুধার্ত উটও মারা যায় তবে আমার ভয় হয় যে আল্লাহ আমাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেন।»

তিনি আরো বলতেন:

«যদি আকাশ থেকে কোন আহ্বানকারী ডেকে বলতেন হে মানবসকল! তোমাদের মধ্যে একজন ছাড়া সকলেই জান্নাতী। তবে আমি ভয়ে থাকতাম যে সে ব্যক্তি আমি হই কি না!»

হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. বলতেন:

«আমার জন্য এটাই ভালো হতো যে আমি মৃত্যু বরণ করবো, কিন্তু পুনরুত্থিত হবো না।»

অথচ তিনি এমন ব্যক্তি যিনি তাসবীহ, সালাত ও তিলাওয়াতে রাত কাটাতেন। তবুও আল্লাহর ভয়ে তাঁর অন্তর এতোটা প্রকম্পিত থাকতো।

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. আল্লাহর এই বাণী তেলাওয়াত করতেন: {অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন।}
[সূরা: আত-তূর, আয়াত: ২৭।]

তিনি নামাযে অনবরত কাঁদতেন, এবং এই আয়াত পড়তেন: {যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস, এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।}[সূরা: আল-মায়েদা, আয়াত: ১১৮।]

আল্লাহর ভয় সংক্রান্ত জ্ঞাতব্য:

১- ভয় প্রসঙ্গে কুরআনে দু'টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হলো 'খাশয়াত' অপরটি হলো 'খাউফ'। 'খাশয়াত' الخشية শব্দটি 'খাউফ' الخوف শব্দ থেকে একটু নির্দিষ্ট অর্থের অধিকারী। 'খাশয়াত' الخشية শব্দটি এমন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য যিনি আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা রেখেই তবে তাকে ভয় করেন: {আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ক্ষমাময়।}[সূরা: আল-ফাতির, আয়াত: ২৮।]

অর্থাৎ 'খাশয়াত' হলো যে ভয়ের সাথে ইলমও থাকে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- «জেনে রেখো! আল্লাহর শপথ আমি তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে অধিক সমীহ করি এবং অধিক ভয় করি।» (-মুসলিম।)

আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, মহত্ব, মর্যাদা ও তাঁর পূর্ণতার ইলমের অনুপাতেই মানুষের মাঝে আল্লাহর ভয় তথা 'খাশয়াত' থাকে।

২- আল্লাহর ভয় তখনই উপকারে আসবে যখন আমল, মুজাহাদা ও যথাযথ তওবার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। অপরাধের পরিণাম সম্পর্কে জানা এবং আল্লাহর শাস্তিপ্রদান সংক্রান্ত হুশিয়ারীকে বিশ্বাস করার মাধ্যমে ভয় সৃষ্টি হয়। এছাড়া আল্লাহর মাহাত্ম্য, বড়ত্ব ও মর্যাদা থেকেও ভয় সৃষ্টি হয়। আমল, মুজাহাদা ও তওবায় উৎসাহিত করে না এমন ভয়কে প্রকৃত ভয় বলে না।

৩- আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ করা ঈমানের একটি অত্যাবশ্যকীয় দাবী। ইহা অন্তরের জন্য উপকারী এবং গন্তব্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছার মাধ্যম। আল্লাহর ভয় প্রতিটি মানুষের জন্য ফরয। এটা পাপ, দুনিয়ার মোহ, অসৎসঙ্গ, আখিরাত সম্পর্কে ঔদাসীন্য ও নির্বোধ মানসিকতা পোষণ থেকে মানুষকে বিরত রাখে: আল্লাহ তা'আলা বলেন:

{আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ক্ষমাময়।} [সূরা: আল-ফাতির, আয়াত: ২৮] যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। আর যে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ভয় করে কেউ তার উপকার করতে পারে না।

-ফুজাইল ইবনে আয়াজ।



Tags: