সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহ তা'আলার অস্তিত্বের ব্যাপারে স্বীকৃতি প্রদান করে, সত্যায়ন করে, বিশ্বাস করে এবং সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ তা'আলা বলেন:
{তাদের পয়গম্বরগণ বলেছিলেন: আল্লাহ সম্পর্কে কি সন্দেহ আছে, যিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের স্রষ্টা? তিনি তোমাদেরকে আহবান করেন যাতে তোমাদের কিছু গুনাহ ক্ষমা করেন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তোমাদের সময় দেন। তারা বলত: তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ! তোমরা আমাদেরকে ঐ উপাস্য থেকে বিরত রাখতে চাও, যার এবাদত আমাদের পিতৃপুরুষগণ করত। অতএব তোমরা কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ আনয়ন কর।}[সূরা: ইবরাহীম, আয়াত-১০]
মুমিন: যিনি আল্লাহ তা'আলার উপর বিশ্বাস রাখেন যে তিনি প্রতিপালক এবং সর্বশক্তিমান। এবং এই বিশ্বাসও রাখে যে, তিনি এককভাবে ইবাদাতের উপযুক্ত। আপনি শুধু অনুগ্রহ ও নেয়ামত লাভের উপর ভিত্তি করে আল্লাহর প্রশংসা করে থাকেন। অথচ আপনি সুখে এবং দু:খে উভয় অবস্থায়ই আল্লাহর মুখাপেক্ষী।এমন সত্তার ব্যাপারে কিভাবে প্রমাণ চাওয়া সমীচিন, যাঁর অস্তিত্বই প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্বের প্রমাণ! তিনিই মহান।
যদি আমরা প্রতিপালকের অস্তিত্বের প্রমাণ অনুসন্ধান করি তবে নিচের বিষয়গুলো আমাদের সামনে চলে আসে-
আল্লাহ শব্দটি মানুষের প্রকৃতিতে অংকিত একটি নাম। সুতরাং এর জন্য কোন দলীল প্রমাণে উপনীত হওয়ার প্রয়োজন হয় না।প্রকৃতিগত প্রমাণ:
মাখলুক স্বভাবগতভাবেই স্রষ্টার উপর ঈমান রাখে। যার কলব ও মস্তিষ্ক থেকে আল্লাহ তা'আলা এই প্রকৃতিকে বিলোপ না করে দিবেন সে তার সৃষ্টিগত প্রকৃতি থেকে হটবে না। ফিতরাত বা প্রকৃতি আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে প্রমাণ বহন করে এর শ্রেষ্ঠ দলীল হচ্ছে রাসূল সা.-এর এই হাদীস-«প্রত্যেক শিশুই ফিতরাত বা প্রাকৃতিক চেতনা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইহুদী, নাসারা ও অগ্নিপূজারী বানায়। যেমন জীব-জন্তুরা নিখুঁত পশুই জন্ম দেয়। তোমরা এর মাঝে কি কোন খুঁত দেখ!» (-বোখারী।)
প্রত্যেক মাখলুকই স্বভাবগতভাবে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকারোক্তি দেয়। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:{তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।}[সূরা: আর-রূম, আয়াত: ৩০।]
এগুলোই হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্বের উপর সৃষ্টিগত প্রকৃতি ও ফিতরাতের প্রমাণ।
শয়তান যাকে প্ররোচিত করেনি আল্লাহর অস্তিত্বের উপর ফিতরাতের প্রমাণই তার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন।}[সূরা: আর-রূম, আয়াত:৩০]
এর পূর্বে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:
{তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ।}[সূরা: আর-রূম, আয়াত:৩০]
সুতরাং সুস্থ প্রকৃতি আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়। আর যাকে শয়তান গ্রাস করে নিয়েছে, তার কাছে এটি অস্পষ্ট থাকে এবং সে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ দাবি করে। অথচ কোন বিপদাপদে পতিত হলেই সে আসমান মুখী হয়ে যায়। কারণ, সৃষ্টিগত প্রকৃতিই তাকে সেদিকে টেনে নেয়।
যুক্তিনির্ভর দলীল:
আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে এমন কিছু দলীল-প্রমাণ এবং শক্তিশালী যুক্তি পেশ করা হচ্ছে নাস্তিক ছাড়া যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যেমন-
১- প্রতিটি সৃষ্টিরই স্রষ্টা রয়েছেন, কারণ সৃষ্টি মানেই স্রষ্টার মুখাপেক্ষী। অথচ এসব সৃষ্টি নিজেদের মাধ্যমে নিজেরা অস্তিত্বপূর্ণ হওয়া অসম্ভব। কেননা কোন বস্তু নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ সৃষ্টির পূর্বে সে নিজেই অস্তিত্বহীন ছিল। তাহলে সৃষ্টিনিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া অবান্তর। সুতরাং প্রতিটি ঘটনারই কোন না কোন সংঘটক রয়েছে। সৃষ্টি জগতের বস্তুসমূহের পরস্পরের মধ্যে এবং প্রতিটি ঘটনা ও পরিণতির মাঝে যে অতুলনীয় শৃঙ্খলা, সঙ্গতিপূর্ণ সামঞ্জস্য এবং পারস্পারিক সংযোগ রয়েছে তা সৃষ্টিসমূহের আকস্মিকভাবে অস্তিত্বপূর্ণ হওয়ার বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করে। প্রতিটি মাখলুকেরই একজন স্রষ্টা রয়েছেন। আর যখন এই সৃষ্টিসমূহের আপনা আপনিই অস্তিত্বপূর্ণ হওয়া অসম্ভব এবং আকস্মিকভাবে তার অস্তিত্বও যখন অযৌক্তিক, তাই স্পষ্ট হয়ে গেলো যে সৃষ্টিসমূহের অস্তিত্বদানকারী একজন রয়েছেন। তিনি হলেন আল্লাহ। যিনি সমগ্র জগতের প্রতিপালক। আর এই যুক্তিভিত্তিক দলীল এবং সুস্পষ্ট প্রমাণটি মহান আল্লাহ তা'আলাও উল্লেখ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন: {তারা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা?}
[সূরা: আত-তূর, আয়াত: ৩৫]
অর্থাৎ মাখলুক স্রষ্টাবিহীন সৃষ্টি হয়নি। আর তারা নিজেরাও নিজেদেরকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেলো যে তাদের স্রষ্টা হলেন মহামহিম সুমহান আল্লাহ তা'আলা। এ কারণে হযরত জাবির বিন মুতঈম রাযি যখন শুনলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম সূরা তূর -এর এই আয়াতগুলো তেলাওয়াত করছেন-
{‘তারা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না তারা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে কি আপনার পালনকর্তার ভান্ডার রয়েছে, না তারাই সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক?’}
[সূরা: আত-তূর, আয়াত: ৩৫- ৩৭]
তখন জাবির রা. মুশরিক ছিলেন, তিনি বললেন: «এ আয়াত গুলো শুনে আমার অন্তর তো উড়ে যাওয়ার উপক্রম!» (-বোখারী।)
২- সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর সৃস্পষ্ট নিদর্শনসমূহও তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষী। আল্লাহ তা'আলা বলেন:
{তাহলে আপনি বলে দিন, চেয়ে দেখ তো আসমানসমুহে ও যমীনে কি রয়েছে।}[সূরা: ইউনুস, আয়াত: ১০১]
কেননা নভোমণ্ডল এবং ভূমণ্ডলের মাঝে দৃষ্টিপাত করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে আল্লাহ তা'আলাই স্রষ্টা। এবং তাঁর প্রভুত্বের ব্যাপারে বিশ্বাস দৃঢ় হয়। একদা এক গ্রাম্য বেদুঈনকে বলা হয়েছিলো কিভাবে তুমি তোমার প্রতিপালককে চিনলে? তখন তিনি বললেন-পদচিহ্ন অতিক্রমকারীর প্রমাণ বহন করে, উটের মল উষ্ট্রীর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। তাহলে সুউচ্চ আসমান, সুপ্রসস্ত জমিন এবং উত্তাল সমুদ্র কেন সর্বশ্রোতা এবং সর্বদর্শীর অস্তিত্বের প্রমাণ করবে না?
বস্তুত: আল্লাহর গায়েবী বিষয়াবলীর সামনে সকল মনুষ্য শক্তি অক্ষম ও অপারক হয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে বাধ্য। সুতরাং মানুষের জাগতিক ধারণার সাথে যখন ঈমান যুক্ত হয় তখনই কেবল সে দিশা লাভ করে।৩- সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত এই পৃথিবী প্রমাণ করে যে এর মহাপরিচালক একক ইলাহ, একক প্রতিপালক। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। আর তিনি ছাড়া মানুষের আর কোন প্রতিপালকও নেই। আর এই বিশ্বজগতের যেমন একাধিক প্রতিপালক বা স্রষ্টার অস্তিত্ব অসম্ভব, তেমনি একাধিক ইলাহ বা মাবুদের অস্তিত্বও অসম্ভব। মোটকথা, একই ক্ষমতাধর দুজন স্রষ্টার মাধ্যমে জগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকাটা প্রকৃতিগতভাবেই অসম্ভব। মানুষের প্রকৃতিতে এই ধারণা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। সুস্থ চিন্তার আলোকে একাধিক স্রষ্টা বা ইলাহের ধারণা বাতিল হয়ে যায়। আর এভাবেই দুজন ইলাহর প্রভুত্বও বাতিল হয়ে যায়।
শরঈ দলীল:
সব শরীয়ত সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও রহমতের পরিপূর্ণতার প্রমাণ বহন করে। কেননা এই বিধানাবলীর একজন বিধায়ক অবশ্যই আছেন। আর সেই বিধায়ক হলেন মহামহিম আল্লাহ তা'আলা। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন:
{হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে। যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাকেও সমকক্ষ করো না। বস্তুত: এসব তোমরা জান।}
[সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ২১- ২২]
সব আসমানী কিতাবেই এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
ইন্দ্রিয়গত দলীল:
পুত-পবিত্র, সুমহান আল্লাহ তা'আলার অস্তিত্বের ব্যাপারে সুস্পষ্ট, উৎকৃষ্ট, অনুভব ও অনুধাবনযোগ্য প্রকাশ্য দলীল প্রত্যেক দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তির কাছেই বিদ্যমান আছে। যেমন:
১- দোয়া কবুল হওয়া: মানুষ আল্লাহ তা'আলাকে ডাকে এবং বলে- হে আল্লাহ! আমাকে অমুক বস্তুটি দান করুন। অত:পর সে যে ব্যাপারে দুআ করে, সে ব্যাপারে তার ডাকে সাড়া মেলে। এটা আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে উপলব্ধিমূলক প্রমাণ। আর মানুষের অন্তর কেবল আল্লাহকেই ডাকে। আর আল্লাহ তা'আলাও তার ডাকে সাড়া দেন। এটিই প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। আর অতীতযুগ ও বর্তমান যুগের এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা শুনি যাদের ডাকে আল্লাহ সাড়া দিয়েছেন। এটি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ব্যাপারে অনুভবযোগ্য বাস্তবিক দলীল। আর এমন অনেক ঘটনা কোরআনেও রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{এবং স্মরণ করুন আইয়্যুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন: আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান।}
[সূরা: আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৮৩- ৮৪]
এছাড়াও আরো অনেক আয়াত রয়েছে।
নাস্তিকতা মূলত: বোধশক্তির দুর্বলতা এবং চিন্তাশক্তির ভারসাম্যহীনতা ছাড়া আর কিছু নয়।২- জীবনের রহস্যের প্রতি মাখলুকের পথনির্দেশলাভও আল্লাহর অস্তিত্বশীলতার প্রমাণ। মানুষকে জন্মের সময় স্বীয় মাতার স্তন থেকে দুগ্ধপানের দিকে পথনির্দেশ করে কে? আর কে হুদহুদ পাখিকে পথনির্দেশ করে? যার ফলে সে জমিনের তলদেশে অবস্থিত পানির সন্ধান দিতে পারে যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দেখে না? নিশ্চয়ই তিনি মহান আল্লাহ। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{মূসা বললেন: আমাদের পালনকর্তা তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথপ্রদর্শন করেছেন।}[সূরা: তাহা, আয়াত: ৫০।]
৩- আল্লাহ তা'আলা যে সকল নিদর্শনাবলী দিয়ে নবী রাসূলদের প্রেরণ করেছেন সেগুলোও আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। সেগুলোকে বলা হয় মুজেযা বা অলৌকিক বিষয়। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ স্বীয় নবী রাসূলদের দাবির যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় বান্দাদের মধ্য থেকে তাঁদেরকে মনোনিত করেছেন। আর প্রত্যেক রাসূলকেই স্বীয় গোত্রের নিকট যখন প্রেরণ করেছেন মু’জিযা দিয়ে, যা প্রমাণ করে নবীগণের আনীত তাওহীদের সত্যতা।
নাস্তিকতা বোধশক্তির দুর্বলতা, চিন্তাশক্তির ভারসাম্যহীনতা, অন্তরের অন্ধকারচ্ছন্নতা এবং জীবনের জন্য ধ্বংসের নামান্তর।