১- অস্থিরতা ও সন্দেহ প্রবণতা থেকে মুক্তি:- যে জানতে পারবে, তার একজন প্রতিপালক রয়েছেন যিনি সকল সৃষ্টির প্রতিপালক। তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন; তাকে সম্মানিত করেছেন এবং তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, জমিনে তাকে খলীফা নিযুক্ত করেছেন, এবং আসমান ও জমিনের মাঝে যা কিছু আছে সবকিছুকে তার অধীন করে দিয়েছেন। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল নেয়ামত তাকে দান করেছেন। এতো কিছু জানার পর সে কিভাবে অস্থির মনোবৃত্তিতে এবং সন্দেহে নিপতিত হবে? অনন্তর সে আল্লাহ অভিমুখী হবে এবং তাঁর আশ্রয়ের প্রত্যাশী হবে। আর সে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকবে যে এই সংক্ষিপ্ত জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণ, ইনসাফ-জুলুম এবং সুখ-দুঃখ সবকিছুরই ছোঁয়া রয়েছে।
আর যারা আল্লাহর প্রভুত্বে অবিশ্বাসী তারা তাঁর সাক্ষাতের ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণকারী। তাদের জীবনের কোন তৃপ্তি ও মূল্য নেই। তাদের পুরো জীবনটা শুধু অস্থিরতা ও দিশাহীনতায় ভরপুর। একের পর এক প্রশ্ন জাগে তাদের মনে কিন্তু তার কোন সদুত্তর নিজেরা পায় না। তাদের কোন আশ্রয়স্থলও থাকে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে স্থির হয়ে যায় তাদের বুদ্ধি। সর্বদাই তাদের বুদ্ধি কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা, সন্দেহ, অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠার মাঝে থাকে। এটা হলো আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসের দুনিয়ার শাস্তি।
২- আত্মিক শান্তি:- নিশ্চয়ই প্রশান্তির একটি উৎস রয়েছে, আর তাহলো আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি ঈমান। খাঁটি ঈমান
ঈমান নাজাতকে ত্বরান্বিত করে।ও দৃঢ় বিশ্বাস, সন্দেহ যাকে পঙ্কিল করতে পারে না, কোন নেফাকী যাকে নষ্ট করতে পারে না- তা যে মানুষকে স্থিরচিত্ত ও প্রশান্ত হ্রদয়ের অধিকারী করে, তা দৃষ্টিসম্পন্ন ও নির্মোহভাবে দেখা যেকোন লোকই উপলব্ধি করে। যুগ যুগ ধরে এর ধারাবাহিকতা আমরা লক্ষ করি। এর বিপরীতে যারা ঈমানের দৌলত ও দৃঢ়বিশ্বাসের শিতলতা থেকে বঞ্চিত, তাদেরকেই সবচেয়ে অস্থির, সংকীর্ণ, উৎকন্ঠায় মগ্ন দেখা যায়। তাদের জীবনের প্রকৃত কোন তৃপ্তি ও স্বাদ নেই। তারা আনন্দ ও আয়েশের সকল উপকরণের মাঝে জীবনযাপন করেও প্রশান্তির দেখা পায় না। কেননা তারা জীবনের কোন উদ্দেশ্যই ঠিক করতে পারে না। পারে না কোন লক্ষ্য স্থির করতে। তাদের মন কোন মহাপ্রাপ্তির আশায় প্রফুল্ল হয় না। সুতরাং তারা অন্তরে প্রশান্তি ও হৃদয়ের প্রশস্ততার মাধ্যমে কিভাবে সফল ও সুখী হবে? অবশ্যই এই প্রশান্তি ঈমানের ফলসমূহের মাঝে একটি ফল। আর একত্ববাদ এমন একটি উত্তম গাছ যা তার প্রতিপালকের নির্দেশে সর্বদাই এর পরিচর্যাকারীকে সুফল প্রদান করে। এটি আসমানী উপহার, যা আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের অন্তরে অবতীর্ণ করেন। যখন মানুষ অস্থিরতায় ভুগবে তখন এই তাওহীদের প্রতি ঈমান তাকে দৃঢ়পদ করবে। যখন সে ক্রোধান্বিত হবে তখন তার মনে তুষ্টি ও সন্তুষ্টি সৃষ্টি করবে। যখন সে সন্দেহে পতিত হবে তখন তাকে বিশ্বাসী করে তুলবে। মানুষ যখন সন্ত্রস্ত হবে তখন তার মাঝে ধৈর্য সৃষ্টি করবে, মানুষ যখন হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে তখন তাকে সহনশীল করে তুলবে। হিজরতের সময় এই প্রশান্তিই রাসূলের অন্তরে পরিপূর্ণ ছিলো। তাই কোন চিন্তা ও বেদনা তাকে আঘাত করতে পারেনি। কোন ভয়ভীতি তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কোন সন্দেহপ্রবণতা ও অস্থিরতা তাকে ভারাক্রান্ত করতে পারেনি। আল্লাহ তা'আলা বলেন:{যদি তোমরা তাঁকে (রাসুলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তাঁর সাহায্য করেছিলেন, যখন তাঁকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তাঁরা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন বিষন্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।}
[সূরা: তাওবাহ, আয়াত: ৪০]
আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর উপর তখন চিন্তা ও অস্থিরতা ছেয়ে গিয়েছিলো। তিনি নিজের জীবনের জন্য চিন্তিত হননি, বরং চিন্তিত হয়েছিলেন রাসূলের ব্যাপারে এবং একত্ববাদের দাওয়াতের ব্যাপারে। এমনকি শত্রুরা যখন গুহা বেষ্টন করে রেখেছিলো তখন তিনি বলেছিলেন-
«ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাদের কেউ যদি তার নিচের দিকে নজর করে, তাহলেই আমাদেরকে দেখে ফেলবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবু বকর! আপনি কি এমন দু’জনের কথা ভাবছেন? যে দু’জনের সাথে তৃতীয় জন আল্লাহ আছেন।» (-মুসলিম।)
এই প্রশান্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এমন আলো ও নূর যা ভয়ে সন্ত্রস্ত ব্যক্তির অন্তরকে প্রশান্ত করে। অস্থিরতার সময়ে সে প্রশান্তি পায়। চিন্তামুক্তির মাধ্যমে সান্ত্বনা পায়। ক্লান্ত ব্যক্তি এর মাঝে বিশ্রাম পায়। দুর্বল ব্যক্তি এর মাঝে শান্তি পায়। পথভ্রষ্ট ব্যক্তি এর মাধ্যমে সুপথ পায়। এই প্রশান্তি জান্নাতের জানালা স্বরূপ। যা আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে মুমিনদের জন্য খুলে দিবেন। জান্নাতের লোকদের তিনি দান করবেন এবং তাদের উপর তাঁর নূরসমূহ উজ্জ্বল হবে। তার ঘ্রাণ ও সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়বে। তারা পূর্বে (দুনিয়াতে) যে উত্তম কাজ করেছে তার মাঝে কিছুর প্রতিদান তাদেরকে আস্বাদান করাবেন। তাদেরকে ছোট কিছু দৃষ্টান্ত দেখাবেন যাতে তারা তাঁর কিছু নেয়ামত দেখতে পারে। যাতে তিনি এই সকল ব্যক্তিবর্গকে রূহ, সুঘ্রাণ, শান্তি, নিরাপত্তা এগুলো দান করতে পারেন।
যে আল্লাহকে যথেষ্ট মনে করে, মানুষেরা তার প্রতি মুখাপেক্ষী হয়। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক যতই দুর্বল হবে ততই সে বিভিন্ন প্রবণতা ও কুমন্ত্রনার লক্ষ্যবস্তু হবে।৩- আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা অর্জন:- প্রতিটি বস্তু তাঁরই আয়ত্বাধীন। লাভ ক্ষতি করাও তাঁরই অধীনে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা মহান সৃষ্টিকর্তা। তিনি রিযিকদাতা, অধিপতি, ব্যবস্থাপক, আকাশমণ্ডলী ও ভূমির লাগাম তাঁরই অধীনে। এজন্য মুমিন যখন এটা বিশ্বাস করবে যে আল্লাহ তার ভাগ্যে যে উত্তম-অনুত্তম, উপকার-ক্ষতি লিখে রেখেছেন তা ছাড়া আর কোন কিছুই তার উপর নিপতিত হবে না-এমনকি সকল মানুষ তার বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে তার অনিষ্ট করতে চাইলেও না -তখন সে এমর্মে নিশ্চিত হবে যে, আল্লাহ একক সত্তা, তিনিই উপকারকারী, তিনিই ক্ষতির মালিক, তিনিই দাতা, ও তিনিই বাধাদানকারী। আর এর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা এবং তাঁর একত্ববাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যাবে। একারণেই যারা আল্লাহ ছাড়া এমন সব ব্যক্তি ও বস্তুর ইবাদাত করে, যারা কোন লাভ-ক্ষতি করতে পারে না- তাদের তিনি তিরস্কার করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন:
{আসমান ও যমীনের চাবি তাঁরই নিকট। যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।}
[সূরা: আয-যুমার, আয়াত: ৬৩]
৪- আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা:- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীর জীবনে এই প্রতিক্রিয়াটি স্পষ্ট। একমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস ও তাঁরই ইবাদাতকারী ব্যক্তি যখন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব ও কতৃত্ব নিয়ে চিন্তা করে, তখন সে কেবল এটাই বলতে বাধ্য যে-{আমার পালনকর্তাই প্রত্যেক বস্তুকে স্বীয় জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন}[সূরা: আল-আন’আম, আয়াত: ৮০]
এবং তিনি বলেন-{(তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই}
[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ১৯১]
এগুলো সবই মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক আল্লাহর সঙ্গে অন্তরের সুগভীর সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে। আর বান্দার সকল চেষ্টা-সাধনা আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য ব্যয় করা ও তাঁর শরিয়তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তথা তাঁর প্রশ্নাতিত অনুকরণ এবং যেসব মাবুদ কোন উপকার বা অপকারের ক্ষমতা রাখে না, তাদের কাউকে মহান আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা থেকে বিরত থাকার বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে আল্লাহর প্রতি বান্দা অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। যা মূলত: একত্ববাদের বিশ্বাসের প্রভাব।
অন্তরের অস্থিরতা আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হওয়া ছাড়া দূর হয় না। অন্তরের নিঃসঙ্গতা তাঁর সাথে গভীর হৃদ্যতা স্থাপন ছাড়া বিদূরিত হয় না। তাঁর পরিচয় জানা এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ছাড়া অন্তরের বিষণ্নতা কাটে না।